জনপ্রিয় অভিনেতা, চিত্রশিল্পী নির্মাতা আফজাল হোসেন লিখেছেন তার ছেলেবেলার গল্প।
গল্প : আফজাল হোসেন
ছবি : নাজমুল আলম মাসুম
দশ ক্লাসে পড়ি তখন। অঙ্কে গোল্লা পেয়েছিলাম প্রি-টেস্ট পরীক্ষায়। হেডস্যার পুত্রের সেই ব্যর্থতা বেশ আয়োজন করে পিতাকে দেখাতে চেয়েছিলেন।
আয়োজন মানে, নলতা থেকে পাঁচ-ছয় মাইল দূরের গ্রাম পারুলিয়াতে খবর পাঠিয়ে স্কুলে আনানো হয় আব্বাকে। দপ্তরি কাসেম ভাই আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে আনেন। তারপর আলমারি থেকে অঙ্ক খাতা বের করে আব্বাকে দেখানো হয়। দেখানো হয় পুত্রের সেই অপমানজনক কীর্তি।
আব্বা হেডস্যারের টেবিলে তার মুখোমুখি বসে ছিলেন। স্যারের সামনাসামনি এবং আব্বার পেছন দিকে অফিসঘরের দরজা। আমি সেই দরজার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
বড় করে শূন্য আঁকা খাতাটা আব্বার সামনে রাখতেই আমার দৃষ্টি শূন্য থেকে অতি দ্রুত আব্বার কানে চলে যায়। দেখতে পাই মুহূর্তেই তার কান জোড়া রক্তাভ হয়ে উঠেছে। ভীষণ রেগে গেলে এ রকমটা হয়ে থাকে বলে জানি।
শূন্য দেখার পর আব্বার প্রতিক্রিয়া যেমনটা হলো-আমি বা হেডস্যার কেউই ধারণা করতে পারিনি। বিশেষ করে হেডস্যার তো মোটেও ভাবতে পারেননি, আব্বার মতো মানুষ আচমকা এমন কা- করতে পারেন।
সদাহাস্য, রুচিমান এবং অতি সজ্জন মানুষ হিসেবে অঞ্চলে তার পরিচিতি। হেডস্যারও সমগ্রঅঞ্চলে সকলের প্রবল সমীহের পাত্র। অতএব যা ঘটল তা স্যারের দিক থেকে খুবই আকস্মিক এবং অপ্রস্তুত করে দেওয়ার মতোই।
আব্বাকে খবর পাঠিয়ে অত দূর থেকে ডেকে এনে পুত্রের খাতার ওপরে আঁকা লাল কালিতে গোল্লা দেখানো হয়। খুব খারাপ লাগারই কথা। কান লাল হয়ে যাওয়ার সাথে কথা জড়িয়ে যেতে দেখে বুঝেছি-শুধুরেগে যাননি, অপমানিতও হয়েছেন।
-স্যার, ছেলে তো আমাদের কাছে থাকে না।
আমি তখন ঘামছি, মেরুদ-ের মাঝখানে শিরশিরানি অনুভব করি। কানের মধ্যেও শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছিল। সামনের দৃশ্য কিছুটা ঝাপসা দেখছি বলেও মনে হতে থাকে। এসবের মধ্যেও পরিষ্কার দেখা গেল, চলে যাবেন বলে উঠে দাঁড়িয়েছেন।
ছেলে আমাদের কাছে থাকে না, থাকে হোস্টেলে। আমরা ভরসা করে আছি, ভালোভাবেই পড়াশোনা করছে সে-জড়ানো গলায় এ রকম কিছুএকটা বলে স্যারকে সালাম দিলেন। মানে জানিয়ে দিলেন, চলে যাচ্ছেন। আমি যে দাঁড়িয়ে রয়েছি দেখলেনই না। পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যান। মাথা নিচুকরে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কী করার থাকে। পেছন থেকে আব্বার মোটরসাইকেল স্টার্টদেওয়া ও গর্জন করে চলে যাওয়ার শব্দ ভেসে আসে। আমাকে বাঘের সামনে রেখে আব্বা চলে গেলেন।
কী করা উচিত বুঝতে চুরি করে স্যারকে দেখতে গিয়ে ঠা-া হয়ে যাই। স্যার ঠা-া চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। ধারালো ছুরির মতো সে তাকানো। বুঝে ফেলি, আমার কপাল পুড়বে এখন।
আমার স্বাধীনতা শেষ হয়ে গেল। হেডস্যারের বাড়িসংলগ্ন ছাত্রাবাসে আমাকে ঢোকানো হলো এবং পরদিন থেকে জীবনধারা গেল পাল্টে।
স্যার ফজরের আজানের সময় ঘরে এসে ঢোকেন। ডাকেন, সাড়া না পেলে কপালে তার হাতের লম্বা নিমের ডালের দাঁতনের বাড়ি দিয়ে ঘুম থেকে তোলেন। তারপর মুরগির বাচ্চার মতো আমরা সাত-আটজনের একটা দল স্যারের পেছন পেছন পুকুর ঘাটে অজুকরতে যাই।
পাশেই মসজিদ। নামাজ শেষ করে স্যার আমাকে নিয়ে বসেন-অঙ্ক করাতে। অঙ্ক দেখলেই আমার মাথা গুলিয়ে যায়, সেই অঙ্ক আমাকে শেখাতে বসেন সাক্ষাৎ যমদূতের মতো স্যার। আবার বসেন তার বিখ্যাত বেতটা নিয়ে। চারটে চিকন বেত একসঙ্গে বাঁধা। ভুল হলেই যেখানে খুশি শপাং। ভয়ে, রক্ষা পেতে অঙ্ক মুখস্থকরতে শুরু করে দিই।
সে মুখস্থের চেষ্টা বৃথা যায়নি। টেস্টের ফল বের হলো। স্কুলের নিয়ম ছিল ক্লাসের মধ্যে নাম ডেকে নম্বর উল্লেখ করে খাতা দিয়ে দেওয়া।
অঙ্ক স্যার নাম ধরে ডাকলেন। উঠে দাঁড়ালাম। বুকে কাঁপন নেই। স্যার নম্বর ঘোষণার আগে কাশলেন, তারপর হাসলেন। ক্লাসের সবাই আমার দিকে তাকায়। অঙ্ক আমার কাছে যন্ত্রণাবিশেষ-অনেকেই জানে। তাই অনেকের চোখেমুখে চাপা কৌতুক। স্যার খাতা নাচিয়ে, উঁচিয়ে ধরে ঘোষণা করলেন, সাতাত্তর।
ক্লাসে হাততালি পড়ে। আমি খাতা নিতে এগিয়ে যাই-হাততালি চলতেই থাকে। এমন ঘটনা আমাদের ক্লাসে, স্কুলে সেই প্রথম।
স্যারের হাত থেকে খাতা নিচ্ছি, সে সময় দেখতে পাই দপ্তরি কাসেম ভাই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। মুখে মৃদুহাসি। কিছুই বলেন না, যেন তিনি ধরে নিয়েছেন তার আসার কারণ আমি বুঝতে পারব, পেরেছি।
বুঝতে পারি, ক্লাস শেষ করে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে।
লম্বা বারান্দা বেয়ে শেষ প্রান্তে স্যারের অফিসঘরের দিকে যাচ্ছি যখন-কান পেতে শোনার চেষ্টা করি, আব্বার মোটরসাইকেলের শব্দ কি শোনা যায়?