গল্প : জাহীদ রেজা নূর
ছবি : নিয়াজ চৌধুরী তুলি
ক্লাস শেষ হলে স্কুল থেকে বের হতে গিয়ে হোঁচট খেল সনকা। ধপাস করে পড়ে গেল উপুড় হয়ে। কাপড়চোপড় সব ধুলোয় মাখামাখি। ক্লাসের অন্য সবাই তো একেবারে হিহ্হি, হোহ্হো! এমনিতেই ক্লাস থ্রির কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না ওর। কেউই ওর নামটা ঠিকভাবে বলে না। কেউ বলে সানোকা, কেউ বলে স্বর্ণকার, কেউ বলে শানুকা। আসলে বলতে হবে ‘শ-নোকা’। এ কথা বারবার বলার পরও কেউ ওর নামটা ঠিকভাবে উচ্চারণ করে না।
তাই ‘হিহ্হি, হোহ্হো’ শুনে সনকার মেজাজ তো তিরিক্ষি হবেই! দূর থেকে ওকে পড়ে যেতে দেখেছিলেন আলপনা ম্যাডাম। তিনি দৌড়ে এসে টেনে তুললেন সনকাকে। ‘সব ঠিক আছে তো?’
ওপর-নিচ মাথা দোলাল সনকা। মানে ঠিক আছে সব। ওর চোখে পানি আসতে আসতেও এলো না। সামলে নিল। এখন যদি কেঁদে দেয়, তাহলে ‘হিহ্হি, হোহ্হো’র সঙ্গে যোগ হবে ‘হাহ্হা, হেহ্হে’! কেন সনকা ওকে নিয়ে ক্লাস থ্রির বাচ্চাদের হাসাহাসি করার সুযোগ করে দেবে?
তাই আলপনা ম্যাডামের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল সনকা, তারপর যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে এগিয়ে যেতে থাকল দরজার দিকে। দরজার বাইরে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। ওকে বাড়ি নিয়ে যাবেন। এ সময় কে যেন বলে উঠল, ‘তুমি তো বেশ সাহসী!’
‘কে কথা বলে?’ সনকা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল আশপাশে কেউ নেই।
ভুল শুনেছে মনে করে সনকা আবার এগিয়ে যেতে থাকল।
‘কী হে, আমাকে দেখতে পাচ্ছ না?’
‘কোথায় তুমি?’ আবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে সনকা কাউকে দেখতে পায় না।
‘এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ কেন? তোমার বুক পকেটেই তো বসে আছি!’
সনকা ওর স্কুল ড্রেসের বুক পকেটের দিকে তাকালো। একটু ফাঁক করে দেখল, পকেটের মধ্যে দিব্যি বসে আছে একটা একআঙুলে মানুষ!
‘তুমি কে?’
‘আমি এক-আঙুলে। তোমার বন্ধু। তোমার নাম শ-নো-কা। ঠিক ঠিক বলেছি না?’
‘একদম ঠিক ঠিক বলেছ।’ হেসে উঠল সনকা। ‘তোমাকে নিয়ে সবাই হিহ্ হি, হোহ্হো করে কেন?’ ‘আর বোলো না। ক্লাসের সময় আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পাখি দেখি, আকাশ দেখি, তাই শিক্ষকের ধমক খাই। হাঁটতে গিয়ে গাছের কাঠবিড়ালির দিকে চোখ যায়, তাই হোঁচট খাই। আমি অন্যদের মতো শুধুপড়াশোনা নিয়ে থাকতে পারি না।’
‘খুব ভালো কথা! শুধুপড়ালেখা করলে পৃথিবী দেখবে কে?’
‘মানে?’
‘মানে আবার কী? তোমাকেই তো আমার চাই। আমারও তো দুনিয়া দেখার শখ! আমরা মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াব। দেখবে, তুমিও একদিন ওদের দিকে তাকিয়ে হিহ্হি হোহ্হো করতে পারবে। ওরা অবাক চোখে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে তখন!’
‘মানে?’
‘ধরো, এখন যদি তোমাকে আমি মিশরের পিরামিড দেখাতে নিয়ে যাই, যাবে?’
‘বাবা যে অপেক্ষা করছেন!’
‘কিচ্ছুহবে না। আমরা যাব আর আসব।’ এই বলে একআঙুলে ফিসফিস করে বলল, ‘ইকরিমিকরি চামচিকরি, করি না আমি কারো চাকরি, এখন যাব মিশরে, পিরামিডের আসরে।’ যেই বলা, পুরো দুনিয়া হয়ে গেল ওলটপালট, আর ওরা দুজন পৌঁছে গেল স্ফিংসের নাকের ডগায়। এক নিমেষে এত কা- ঘটল দেখে সনকা ভয় পেয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আবার পরে আসব, এখন চলো, বাড়ি যাই!’
এক-আঙুলে হেসে বলল, ‘আমরা অনেক জায়গায় যাব। তৈরি থেকো। আর আমাকে রেখো তোমার টেবিলের ড্রয়ারে ভেতর। বুঝেছ?’
‘বুঝেছি!’ বলে পিরামিডের কাছ থেকে একটা পাথরখ- তুলে নিল সনকা।
আবার দুনিয়া ওলটপালট করে ওরা ফিরে এলো স্কুলে। সনকা ধরল বাবার হাত আর মাঝে মাঝে পকেট খুলে দেখে নিতে লাগল, এক-আঙুলে আছে কি না।
পরদিন স্কুলে যাওয়ার পর সবাই যখন সনকাকে দেখে হিহ্হি, হোহ্হো করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন সনকাই বলল, ‘জানিস, আমি কাল পিরামিড দেখতে গিয়েছিলাম! এই দ্যাখ, মিশরের পাথরখ-!’
ওরা হামলে পড়ে পাথরটা দেখল। কেউ হাসল না। শুধু নেড়েচেড়ে পাথরটা দেখতে লাগল। শুধুএকজন মুখের পেশি শক্ত করে বলল, ‘গুল মারছিস!’
সনকা ওদের হাত থেকে পাথরটা নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘হিহ্হি, হোহ্হো! কাল যাব আফ্রিকার জঙ্গলে!’