গল্প : কামাল হোসাইন
ছবি : এস এম রাকিবুর রহমান
পহেলা বৈশাখ প্রায় এসেই গেল। এর মধ্যেই চৈত্রসংক্রান্তির মেলা শুরু হয়ে গেছে। আর মোটে দুটো দিন। এর পরই বৈশাখী মেলা শুরু হয়ে যাবে। চারদিকে সাজসাজ রব পড়ে গেছে। রাতুলের চোখে ঘুম নেই। এই মেলার জন্য সারা বছরই সে ওদের মাটির তৈরি ঘরের খুঁটিতে ছিদ্রকরা ব্যাংকে এক-দুই টাকা করে জমিয়েছে। কখনো ঘুঁটে কুড়িয়ে, কখনো শুকনো পাতা কুড়িয়ে বিক্রি করে ওই টাকা সে জমিয়েছে। এ ছাড়া বাপহারা মা তাকে মাঝে মাঝে মিঠাই কিনে খাওয়ার জন্য যে এক-আধ টাকা দিয়েছে, তা থেকেও পয়সা বাঁচিয়ে এই বাঁশের খুঁটির ব্যাংকে জমিয়েছে। উদ্দেশ্য হলো, পহেলা বৈশাখের মেলা শুরু হলেই ওই ব্যাংক থেকে জমানো টাকা বের করবে। আর ওর ইচ্ছেটা হলো, জমানো টাকায় লাট্টুসহ দুটো সুন্দর লাটিম কিনবে, আর বাকি টাকায় মায়ের জন্য নোলক আর ছোট বোন মাসুমার জন্য একটা পুঁতির মালা কিনবে। আর যদি দুচার টাকা বাঁচে, তখন গুড়ের জিলাপি আর নিমকি কিনে বাড়ির পথ ধরবে।
এসব কথা মাকে সে বলেনি কিন্তু। সে চায় মেলা থেকে ওসব কিনে, বিশেষ করে মায়ের নাকের বাহারি নোলক কিনে এনে মায়ের হাতে দিয়ে তাকে চমকে দেবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। মেলা শুরুর আগের দিনই বাঁশের খুঁটির ব্যাংক থেকে টাকা বের করল। গুনে দেখল মোট ছাপ্পান্নটাকা হয়েছে। এই টাকাই রাতুলের কাছে অনেক। নিজের জমানো টাকা বলে কথা!
সেদিন সকাল। ভোরেই ঘুম ভেঙেছে ওর। মেলায় যাওয়ার আনন্দ ওর চোখে-মুখে। কিন্তু মেলাটা ঠিক বিকেলে ছাড়া জমে ওঠে না। সাতসকালে মেলায় গিয়েও লাভ নেই। গ্রামের মেলা। দোকানিরা দুপুরের পরপরই তাদের জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসে।
রাতুলের যেন সময় কাটছে না। কোনো রকমে দুপুর হলেই রাতুলের আর পায় কে? ছুট লাগাল সে। মেলা যেন তারই নাম ধরে ডাকছে। খালি পা। ধুলো উড়িয়ে মেলার দিকে ছুটল রাতুল।
আর কিছুক্ষণ। সামনের একটা বাঁক পেরোলেই মেলার মাঠ চোখে পড়বে। অবশ্য মেলা যে বটগাছটার নিচে বসে, সেটা অনেক দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে। রাতুলের বুকের ভেতর খুশিরা ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছে এরই মধ্যে।
পথের বাঁকে চলে এলো রাতুল। ওখানে গিয়ে দেখল একটা মানুষ পথের ধুলোয় শুয়ে গোঁঙাচ্ছে। রাতুল কৌতূহল নিয়ে লোকটার কাছে গেল। লোকটা এভাবে পড়ে থাকলেও পথচলতি কেউ তার কাছে যাচ্ছে না। পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে সবাই। রাতু লের মনে হচ্ছে লোকটা কিছুবলতে চায়। যে যাচ্ছে, তার দিকেই হাত ইশারায় কাছে ডাকতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউই থামছে না।
রাতুল তা পারল না। গুটিগুটি পায়ে কাছে গেল লোকটার। হাঁটুমুড়ে বসল তার সামনে। রাতুল বুঝল লোকটা হাঁপাচ্ছে। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
রাতুল লোকটার মুখের কাছে তার কান নিয়ে গেল। লোকটা কী বলতে চায়, তা সে শুনতে চায়। লোকটা ছোট ছেলেটাকে তার কাছে বসতে দেখে ফ্যাসফেসে আর নিচুগলায় বলল, তুমি আবার দাঁড়ালে কেন খোকা? মেলায় যাচ্ছিলে না? চলে যাও।
রাতুল লোকটার কথায় কান না দিয়ে বলল, তোমার কী হয়েছে দাদু? তুমি এভাবে ধুলোর ভেতর শুয়ে আছ কেন? মনে হচ্ছে তুমি কিছুবলবে। বলো না, কী বলতে চাও!
লোকটার পরনে একটা ময়লা লুঙ্গি। গায়ে ততোধিক ময়লা একটা জামা। চুল এলোমেলো। বৈশাখের গা-পোড়া তাতানো রোদে লোকটা কাহিল।
লোকটা আর সময় নিল না। বলল, আমাকে দাদুবললে যখন, তোমাকে বলাই যায়। তবে তার সমাধান তো করতে পারবে না খোকা।
এ কথা বলে লোকটা হাঁপাতে লাগল। বোঝা যাচ্ছে তার কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে।
রাতুল বলল, আহা বলোই না দাদু। যদি কোনো কাজে লাগতে পারি তোমার। আমার তো কোনো কাজ নেই, তাই… লোকটা এবার বলল, তুমি তো বেশ কথা জানো খোকা!
শোনো বলি, আমি এক অসহায় মানুষ। বাড়ি আমার পাশের গ্রামে। খুবই গরিব আমি। শ্বাসকষ্টের রোগী। কোনো কাজ করতে পারি না। ক’দিন পর পর এই রোগের জন্য প্রায় দুই শ টাকার ওষুধ লাগে। আমার তো কোনো আয় নেই।
আবার এই ওষুধ না হলেও বাঁচি না। কালই আমার ওষুধ ফুরিয়েছে। কেনার মতো পয়সা আমার হাতে নেই। কাল থেকে পেটে কিছুনা দিয়ে কোনো রকমে দেড় শ টাকা জোগাড় করতে পেরেছি। বাকি টাকার জন্য এই রাস্তায় পড়ে আছি দাদু। কিন্তু কারোরই যেন মন গলছে না। দয়ামায়া নেই এই অভাগার ওপর…বলেই লোকটা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
লোকটার কথা শুনতে শুনতেই রাতুলের মনটা কেমন হয়ে গেল যেন। বলল, কী ওষুধ আনতে হবে দাদু? কই তোমার ওষুধের ফর্দটা দাও দেখি। তোমার কাছে থাকা টাকাগুলোও দাও। বলেই অনেকটা জোর করেই লোকটার কাছ থেকে ওষুধের ফর্দআর টাকাটা নিয়ে দৌড় লাগাল রাতুল।
লোকটা কিছুবুঝে ওঠার আগেই ঘটনাটা ঘটল। রাতুল তাকে কিছুই বলার সুযোগ দিল না।
রাতুল করল কী…তার কাছে থাকা টাকার সঙ্গে লোকটার কাছ থেকে পাওয়া টাকা মিলিয়ে ফেলল। এই বাজারের ওষুধের দোকান তার চেনা। সেখানে গিয়ে হাজির হলো হাঁপাতে হাঁপাতে।
ফর্দটা তারই বয়সী দোকানের ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি এই ওষুধগুলো দাও তো ভাই। টাকা এনেছি, কত লাগবে বলো?
সেলসম্যান ছেলেটা ফর্দদেখে বলল, এক শ নব্বই টাকা। টাকা দিয়ে ওষুধগুলো নিয়ে হাতে থাকা ষোলো টাকায় লোকটার জন্য খাবার কিনল রাতুল। খাবার বলতে পাউরুটি আর কলা। কারণ ও জানে খালি পেটে ওষুধ খেতে হয় না। দৌড়ে ফিরে এলো কিছুসময়ের মধ্যেই। লোকটা তখনো ধুলোর ভেতর শোয়া। তার কাছে গিয়ে রাতুল বলল, এখন ওঠো তো দেখি, ওই গাছের ছায়ায় বসবে চলো।
লোকটা শুধুতাজ্জব হয়ে রাতুলের কাজ দেখে যাচ্ছে। কিছু বলতে পারছে না। উঠে ওর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল। গাছের ছায়ায় বসে রাতুলের আনা কলা আর পাউরুটি খেলো। তারপর পাশে থাকা টিউবওয়েল থেকে পানি খেলো। ওষুধ খেলো। এতে মনে হলো লোকটা অনেকটা সুস্থঅনুভব করল। রাতুলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে পর পর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভাবতে লাগল লোকটা। চেনা নেই, জানা নেই। এতটুকুএকটা ছেলে, কীভাবে তার সাহায্যে এগিয়ে এলো! ভাবতে পারছে না লোকটা। এরপর লোকটা ওর মাথায় হাত রেখে বলল, দাদুভাই, তোমার এই ছোট্ট মনের মধ্যে যে ভালো মানুষটা বাস করছে, এই মনের কারণে তুমি মানুষের অনেক দোয়া পাবে। আমিও তোমাকে অনেক দোয়া করছি। আল্লাহ তোমাকে অনেক ভালো করুক। কিন্তু একটা কথা বলো তো দাদুভাই, আমার তো মনে হয় তুমি যে টাকা নিয়ে মেলায় যাচ্ছিলে, তার পুরো টাকাটাই আমার ওষুধ আর খাবার কিনতে খরচ করে ফেলেছ। তুমি যে উদ্দেশ্যে মেলায় যাচ্ছিলে, তার তো কিছুহলো না!…
রাতুল বলল, তোমার কথাই ঠিক দাদু। আজ আমি মেলায় যাচ্ছিলাম কিছুজিনিস কিনব বলে। আমার জন্য, মায়ের জন্য আর ছোট বোনের জন্য দু-একটা জিনিস কিনব বলে মেলায় যাচ্ছিলাম। কিন্তু তোমার এই কষ্ট দূর করতে সহযোগিতা করতে পারার যে আনন্দ, তা ওই সব জিনিস কেনার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় দাদুভাই।
মাকে বলব, আজকের এই বছরের প্রথম দিনে তোমার জন্য এটুকুযে করতে পারলাম, এটাই আমার আনন্দ। এটাই আমার পহেলা বৈশাখ। নতুন বছরের নতুন কিছু।