তু খা, মু খা - ইকরিমিকরি । আমাদের স্বপ্নরাজ্য
তু খা, মু খা

তু খা, মু খা

গল্প : প্লাবন ইমদাদ
ছবি : হৃদিতা আনিশা

এষার অঙ্ক শিক্ষক অসুস্থ, তাই শেষ ক্লাসটা আজ হবে না। বাইরে খড়খড়ে রোদ। মা ওকে নিতে আসবেন আরো ঘণ্টাখানেক পর। বাসায় নানুমণি এসেছেন। তাই মনটা ইশপিশ করছে বাসায় ফেরার জন্য। কিন্তু ও একা কীভাবে যাবে?

একা ও পথ চেনে আর দিব্যি যেতে পারে। কিন্তু মা বকা দেবেন। ছোট বাচ্চাদের পথে নানা বিপদ হতে পারে বলে মা সব সময় সাবধান করেন। একা তাই স্কুলের বাইরে পথে বের হওয়াও নিষেধ।

কিন্তু মন যে আজ কিছুতেই মানছে না। নানুমণি এসেছেন এত দিন পর। কত্ত মজা হবে! অনেক ভেবে ও সিদ্ধান্ত নিল, আজ একাই বাসায় চলে যাবে। মা হয়তো একটুবকাবকি করবেন; কিন্তু মার আজ একটা ধারণা হবে যে এষা একা সত্যিই বাসায় ফিরতে পারে।

ক্লাস টিচারকে না জানিয়ে ও একা রওনা দিল বাসার উদ্দেশে। হাঁটার পথ মিনিট বিশেকের। পিঠে ঝোলানো গোলাপি রঙের ব্যাগে মায়ের বানানো নুডলস। খিদে নেই।

বাসায় গিয়ে খাওয়া যাবে। ও জীবনে প্রথমবার একা বাড়ির পথে হাঁটছে। অসাধারণ রোমাঞ্চ কাজ করছে। নিজেকে অনেক বড় বড় মনে হচ্ছে ওর। মা শুধুশুধুহাঁটার সময় হাত ধরে রাখেন। হাত ধরে রাখলে পথের পাশে ফুটে থাকা ফুল ছুঁয়ে দেওয়া যায় না, ইচ্ছে হলে অকারণে একটা লাফ দেওয়া যায় না। আজ ও ইচ্ছেমতো পথের পাশের ফুল, লতাপাতা ছুঁয়ে দেখছে। ব্যাগে বেশ ক’টা ফুলও ছিঁড়ে নিয়েছে বাসায় গিয়ে খেলা করার জন্য। বেশ কয়েকবার অকারণে লাফ দিয়েছে। লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটলে কেমন একধরনের পুলক অনুভব হয়। বাবা মজা করে বলেন, ‘ওভাবে তো ব্যাঙ লাফায়। তুমি কি ব্যাঙ-কন্যা?’ ব্যাঙ-কন্যা হলে সমস্যা কী? ব্যাঙ সারা দিন পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করতে পারে। এষা পারে না। তাই ব্যাঙ-কন্যা হওয়া ঢের ভালো।

এলোমেলো কত কী ভাবতে ভাবতে ও বাড়ির পথের মাঝামাঝি জায়গায় যে বিশাল বটগাছটা আছে ওটার তলায় চলে এসেছে। বটগাছটায় অদ্ভুত সব পাখি থাকে। এদের মধ্যে লাল ঠোঁটের টিয়ে পাখি দেখতে এষার ভীষণ ভালো লাগে। টিয়ে পাখি নাকি মানুষের বাড়ির উঠোন থেকে শুকনো মরিচ চুরি করে খায়। অবাক লাগে ওর। ওদের কি ঝাল লাগে না ঠোঁটে! হয়তো কাঠের মতো শক্ত আর লম্বা ঠোঁট বলে ঝাল লাগে না।

পাখি দেখার জন্য ও একটুবটের গোড়ায় বসল। বেশ শীতল হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। ওপর দিকে অবাক তাকিয়ে ও পাখিদের কিচিরমিচির কথোপকথন দেখছে। বেশ মজার জীবন ওদের। নিজেরও খুব ইচ্ছে করছে বটগাছের মগডালে উঠে ওদের সাথে কথা বলতে।

দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা বিশাল ছায়ার মতো কী যেন নেমে এলো এষার একেবারে গায়ের ওপর! গব কিছুঅন্ধকার হয়ে এলো ওর। কেবল মনে হলো ভেড়ার লোমের মতো নরম কোনো বিশাল হাত ওকে ওপরে তুলে নিচ্ছে। মুহূর্তের জন্য হতভম্বহয়ে গেল এষা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ও দেখতে পেল গাছের মগডালে একটা নরম লোমের বিছানার মধ্যে শুয়ে আছে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো ব্যাপারটা। বিশাল দেহধারী এক দৈত্যের নরম তুলতুলে কোলে ও হেলান দিয়ে বসে আছে। দেখে ভয় পাওয়ার কথা হলেও দৈত্যের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়টা কেটে গেল।

খুব কোমল আর নীরিহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দৈত্যটা এষার দিকে। দৈত্যটা এষাকে এবার মগডালের ওপর পাতার তৈরি ছোট্ট চেয়ারে বসিয়ে ওর স্কুলব্যাগটা খুলল। ব্যাগের সব জিনিসপত্র একটা একটা করে দেখতে লাগল। এষার ভয়ের বদল কেবল কৌতূহল হচ্ছিল তখন।

দৈত্যটা শেষমেশ ওর টিফিন বক্সটা আবিষ্কার করল। ওটা খুলে এষার মায়ের হাতে তৈরি সুস্বাদুনুডলসের ঘ্রাণ শুঁকে কেমন মাতাল হয়ে গেল বিশালাকায় দৈত্যটা। বক্সটা দুজনের মাঝখানে রেখে মুখোমুখি বসে এক অদ্ভুত শব্দ করতে শুরু করল :

‘তুখা, মুখা; তুখা মুখা; তুখা, মুখা।’

এষা কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝল না। কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। দৈত্যটা অনেক্ষণ একই শব্দ করতে করতে একটা লম্বা হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়ল। এষাও অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতায় ঘুমিয়ে পড়ল পাতার চেয়ারে।

ঘুমের ঘোরে এষা অদ্ভুত এক স্বপ্নদেখল। স্বপ্নেমা রান্নাঘরে এষার প্রিয় নুডলস রান্না করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে ওই দৈত্যটার মতো বলতে থাকলেন, ‘তুখা, মুখা; তু খা মুখা; তুখা, মুখা।’ এষা রাগে চিৎকার করে উঠল। মা অমনি এষাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এষা, এটা দৈত্যদের ভাষা। এটার মানে হলো আসো তুমিও খাও আমিও খাই।’

এষার স্বপ্নভেঙে গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে দেখল যে দৈত্যটা গভীর ঘুমে নাক ডাকছে। এষা একটা চিকন বটের ডাল হাতে নিয়ে দৈত্যটার মস্ত পেটে একটা খোঁচা দিল। অমনি দৈত্যটা ধড়ফড় করে লাফিয়ে উঠল। সে কিছুবোঝার আগেই এষা হাসতে হাসতে বলা শুরু করল, ‘তুখা, মুখা; তুখা, মুখা; তুখা, মুখা।’ দৈত্যটা অমনি মুচকি হেসে লোমওয়ালা হাত বাড়িয়ে প্রথমে এষার মুখে, পরে নিজের মুখে নুডলস তুলে নিল। তারপর দুজন মিলে বেশ মজা করে ভরপেট নুডলস খেলো।

ওদিকে তো এষার মা এষাকে চারদিকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। দৈত্যটা এটা বুঝতে পেরে খাওয়া শেষ করেই এষাকে দুই হাতে নিজের পিঠে তুলে নিয়ে উড়াল দিয়ে এষাদের বাসার উঠানে নেমে এলো। এষার মা-বাবা, নানুসহ সবাই দৌড়ে এলেন। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এষা দৈত্যের পিঠ থেকে এক লাফে নেমে তার দিকে তাকিয়ে জোরে বলে উঠল, ‘তু খা, মুখা’। দৈত্যটা হাসির মতো একটা অদ্ভুত শব্দ করে সেখান থেকে উধাও হয়ে গেল।

কেউ কিছুনা বুঝে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কেবল এষা একা একা ‘তুখা, মুখা’ বলে বলে বিড়বিড় করতে করতে ঘরে চলে গেল।

আপনার মতামত দিন

Shopping Cart